বাণিজ্য প্রতিবেদকঃ আজ ০৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখ সোমবার সকাল ১১:০০ টায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে (১ কারওয়ান বাজার, টিসিবি ভবন-৮ম তলা, ঢাকা খোলা সয়াবিন তেল বিপণন ও বিক্রয় বন্ধ বিষয়ে সচেতনতানূলক সভার আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য, সভায় সভাপতিত্ব করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) জনাব এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক জনাব মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারসহ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকগণ, ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি, বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধি, এনএসআইয়ের প্রতিনিধি, ক্যাবের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, রুপচাঁদাসহ বিভিন্ন ভোজ্যতেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি, কারওয়ান বাজার ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ।
আলোচনার শুরুতেই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজকের সচেতনতামূলক সভা আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ কার্যকর হওয়ার পর থেকে ভোজ্য তেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ করার বিষয় ছিল। আমরা খোলা তেলে ভিটামিন A পাচ্ছি না। খোলা তেলে ভিটামিন A মিশানো হলেও প্রক্রিয়াজাত করার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভিটামিন A থাকছে না। এছাড়াও তিনি ড্রামে যে প্রসেসে তেল সংরক্ষণ করা হচ্ছে তা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, ড্রামগুলো ফুড গ্রেড কিনা, খোলা ড্রামে পোকামাকড় থাকার বিষয়েও আলোচনা করেন। মূলত এই সকল কারণে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০২২ সালের ০২ জুন পরিপত্র জারি করে ৩১ জুলাই ২০২২ থেকে খোলা সয়াবিন তেল এবং ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণ বন্ধের পরিপত্র জারি করা হয়। গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কমিটির মিটিং এ এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বর্ণিত মিটিং এ মিলসমূহ অবগত করেন তারা ভোজ্যতেল প্যাকেটজাতকরণের বিষয়ে প্রস্তুত রয়েছেন। এখন যেহেতু ভোজ্যতেলের মূল্য কমে এসেছে তাই আমরা এ বিষয়ে তদারকি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
মহাপরিচালক আলোচনায় আরও বলেন, খুচরা পর্যায়ে দেখা যায় সুপার পাম তেলকে সয়াবিন তেল হিসেবে বিক্রয় করছে। এক্ষেত্রে কোন কোম্পানিকে সনাক্ত করা যাছে না কারণ ড্রামে কোন তথ্য থাকে না। এছাড়াও লিটার প্রতি ১৫-২০ টাকা বেশি বিক্রি করার প্রবণতা দেখা যায়। আমরা সকলের সমন্বয়ে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি খোলা সয়াবিন তেল বন্ধে কাজ করতে চাই।
মহাপরিচালক সভায় বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে খোলা তেল বাদ দিয়ে প্যাকেটজাত তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা মুল্য বৃদ্ধি পেলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় খোলা সয়াবিন তেল পরিহার করা উচিৎ। এছাড়াও খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের ছোট পেট বোতল, পাউচ প্যাক ও মিনি প্যাক প্রস্তুত করা যেতে পারে। মূলত এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আজকের সচেতনতানূলক সভার আয়োজন করা হয়েছে।
আলোচনায় এস আলম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার বলেন, আমার শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বন্ধের বিষয়ে মটিভেশনে যখন কাজ হয়নি তখন আইনে পরিণত করা হলো। তিনি বলেন, আমাদের প্যাকিং করার সক্ষমতা চাহিদা অনুযায়ী নেই তাই শতভাগ প্যাকিং এ যাওয়া কঠিন।
সভায় মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি জানান, খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বন্ধের বিষয়ে আমরা একমত কিন্তু আমাদের সক্ষমতা বিবেচনা করে তা শতভাগ বাস্তবায়নে সময় দিতে হবে।
আলোচনায় টিকে গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, খোলা তেল বিক্রি বন্ধের বিষয়ে আমরা একমত তবে পাম তেল চালু রেখে খোলা সয়াবিন তেল বন্ধ করাটা কঠিন হবে।
সভায় বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের প্রতিনিধি জানান তারা কোন খোলা তেল বাজারজাত করেন না। তিনি আরও বলেন প্যাকিং এর ক্ষেত্রে পাউচ প্যাক প্রস্তুত করা হলে খরচ কমে যাবে।
অত;পর অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জনাব আব্দুল জব্বার মন্ডল খোলা ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে বাজার অভিযানে প্রাপ্ত অসংগতি সমূহ যথা; অস্বাস্থ্যকর পরেবেশ, ড্রামে তেলের নাম, মেয়াদ ও প্রতিষ্ঠানের নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকা, তেলে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা, বেশি দামে বিক্রি ইত্যাদি বিষয়ে সভায় উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জানান, খোলা সয়াবিন তেলের পাশাপাশি অন্যান্য খোলা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন হঠাৎ খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বন্ধ করা হলে আমাদেরে মত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মহাপরিচালক বলেন, আমরাতো আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের একটা সময় শুরু করতে হবে। আইনের বাস্তবায়ন করতেই হবে তাই আমরা আপনাদের সহযোগিতায় সকলে মিলে তা বাস্তবায়ন করতে চাই।
আলোচনায় বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধি জানান, তাঁদের সাম্প্রতিক সার্ভে অনুযায়ী নমুনা ভোজ্য তেলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন A এর উপস্থিতি যাচাইয়ের লক্ষ্যে জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ৯৭০টি নমুনা তেল(২০৪ টা ড্রামের খোলা তেল ও ৭৬৬ টি বোতলজাত তেল) নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ৮৩৭ টি নমুনা পাশ করে এবং ১৩৩ টি ফেল করে যার মধ্যে ১০৪টিই খোলা ড্রামের তেল। অর্থাৎ খোলা ড্রামের তেলের ৫২ % নমুনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন A এর উপস্থিতি পাওয়া যায় নি। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে খোলা সয়াবিন তেল বাজারজাতকরণ বন্ধের পক্ষে সহমত পোষণ করেন।
সভায় এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক বলেন, আমাদের এফবিসিসিআইয়ের মিটিং এ খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের বিষয়ে বলা হয়েছে । তিনি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শতভাগ খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের কিছুটা সময় দেয়ার কথা বলেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে খোলা সয়াবিন তেল বন্ধ করা উচিৎ। তাছাড়া নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য তো পাম তেল ক্রয়ের সুযোগ থাকছে।
সভায় ক্যাব প্রতিনিধি খোলা তেলের মাধ্যমে ভোক্তারা যেন প্রতারিত না সে লক্ষ্যে তাই দ্রুত খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের দাবী জানান।
আলোচনায় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে সিটি গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন অনেক শিক্ষণীয় একটা সভা হয়েছে। তিনি পাউচ প্যাকে তেল বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে পোকামকড়ে প্যাকেট কেটে ফেলার সমস্যা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চাপে প্যাকেট ফেটে যাওয়ার সমস্যার কথা বলেন।তিনি আরও বলেন, খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই এবং এক্ষেত্রে মিল মালিক থেকে শুরু করে সকলের মধ্যে এক্ষেত্রে সমন্বয় প্রয়োজন।
আলোচনায় অধিদপ্তরের পরিচালক জনাব মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয় আমরা দেখি, সে ক্ষেত্রে আমাদের অঙ্গীকার আছে কিনা এবং কতটুকু এগিয়েছি তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রয় বন্ধের সময়সীমা ৬ (ছয়) মাস বর্ধিতকরণের আবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিলগুলো ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে কোন মাসে কতটুকু পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা অধিদপ্তরে দাখিল করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন খোলা সয়াবিন তেল বিক্রয় বন্ধে সকলকে সমন্বিত হয়ে কাজ করতে হবে।
সার্বিক আলোচনা শেষে মহাপরিচালক বলেন, আমরা খোলা সয়াবিন তেল তদারকির পূর্বে সংশ্লিষ্ট মিলগুলোতে অবগত করেছি। অতঃপর ১ আগস্ট ২০২৩ তারিখে খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের বিষয়ে সারা দেশে মোটিভেশনাল তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করেছি । আজকের সভার আলোচনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন সরকারের নিকট তুলে ধরা হবে। খোলা সয়াবিন তেলের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের মনিটরিং ও প্রচারণা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রয় বন্ধের সময়সীমা ৬ (ছয়) মাস বর্ধিতকরণের আবেদন দাখিল করা হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে মিলসমূহ খোলা সয়াবিন তেল ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে কিভাবে বিক্রয় বন্ধ করবে তার কর্মপরিকল্পনা আগামী সাত দিনের মধ্যে অধিদপ্তরে প্রেরণ করতে হবে। প্রাপ্ত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রমের অগ্রগতি অধিদপ্তর কর্তৃক পর্যায়ক্রমে মনিটরিং করা হবে।তিনি সভা শেষে সকলের সহযোগিতায় ০৬ (ছয়) মাসের মধ্যে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রয় বন্ধ শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করে সভায় উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।