শুক্রবার ,   ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ,   ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,  ২৩শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
Cnbnews

এইডস থেকে বাঁচতে হলে জানতে হবে

Print Friendly, PDF & Email

এইডস! এখনও এক ভয়ঙ্কর ঘাতক ব্যাধি। রোগটির নাম শুনলেই সবাই কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যে রোগটির বিস্তারে এ পর্যন্ত ৪০ মিলিয়নের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যার বেশীর ভাগের পরিণতি কেবল অবশ্যম্ভাবী করুণ মৃত্যুÑ তার প্রতিক্রিয়ায় এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের দেশও আজ এর মরণ থাবায় আক্রান্ত। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম একজন পুরুষের শরীরে এইডসের জন্য দায়ী এইচআইভি ধরা পড়ে।

৯১ সালে নয়জনের মধ্যে দু’জন নারীও আক্রান্ত হয়। তারপর থেকে প্রতিবছর এ দেশে এইচআইভি পজিটিভের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউএন এইডসের রিপোর্ট অন দ্য গ্লোবাল এইচআইভি/এইডস এপিডেমিক ২০২১-এ, দেশে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার উল্লেখ করা হয়।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ হাজার ১০০ জন নতুন করে এইচআইভি আক্রান্ত হচ্ছে। যেসব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের কারণে এ রোগটি সংক্রমিত হতে পারে দেশে সেসব আচরণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ আচরন না বদলালে যে এটা বেড়ে এক ভয়াবহ রুপনিবে তা এখনই বুঝা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এত ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের কালচার, তারপরও বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনও মহামারী অবস্থা শুরু হয়নি।

আমাদের দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্র : একজন দন্ত চিকিৎসক হাতে গ্লাভস, ডেন্টাল চেয়ারটিতে তার রোগীর স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। পরবর্তী রোগীটিকে একই সতর্কতায় দন্ত চিকিৎসা করবেন। অবশ্যই প্রথমজনের যেকোনো থুথু বা স্যালাইভার কাটামিনেশন বা সংস্পর্শ ছাড়াÑ এটাই হচ্ছে একটি আদর্শ চিকিৎসারূপ। এই ব্যাপারটি সব দেশেই কঠোরভাবে মানা হয়।

তাই যেকোনো উন্নত ও উন্নয়ণশীল দেশেই চিকিৎসাসেবা তুলনামূলক আমাদের দেশের চাইতে বেশি ব্যয়বহুল কিন্তু আমরা সাধারণভাবে যা করি যেমন সরকারি হাসপাতালগুলোতে তাতে গ্লাভস ব্যবহার না করেই রোগীর মুখে হাত দিই। এটি কিন্তু অন্যায়। তারচেয়ে বড় অন্যায় অন্যের মুখের থুথুর সংস্পর্শে আসা মিরর বা প্রব খুব সহজেই অন্যের মুখে দিয়ে রোগ নির্ণয় করি।

ডিসপোজেবল মিরর বা প্রব ব্যবহার করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ব্যয়বহুল বটে। তবে অনেক প্রব বা মিরর একসঙ্গে থাকলে বার বার তা পাল্টে নেয়া যেতে পারে। পুনরায় সাধারণ পানি বা ফুটানো পানিতে ধুয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

যেই দাঁতটির কাজ করা হবে তা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের সাহায্যে একটু ভালোভাবে মুছে নিলেও অনেকখানি জীবাণুমুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নিতে পারি। যে বার বা দাঁত ড্রিল করার যন্ত্র ব্যবহার করব তা অটোক্লেভ করে নেয়াই ভালো, সম্ভব না হলে অন্তত অ্যালকোহলে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করা যেতে পারে। অন্তত আগুনে ২/৩ বার পুড়িয়ে নিলেও চলে। ছোট ছোট যন্ত্রপাতি যেমন বিয়ার ফাইল এসব অ্যালকোহল স্পঞ্জে রাখা যায়। সাধারণ স্যালাইন গজে রাখলে ৯৮% জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়। লাইসল ব্যবহার করা যায় যন্ত্রপাতিগুলোকে দ্রুত জীবাণুমুক্ত করার জন্য। সর্বোপরি যথাসম্ভব আমাদের ডিসপোজেবল জিনিস ব্যবহার করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে গরিব রোগীর ভিড়ে একজনের সুই-সুতো দিয়ে অন্যজনের সেলাই করা হয়। একান্ত করতে হলে তা লাইসলে ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে। আর অটোক্লেভ মেশিন ও অন্যান্য দরকারি যন্ত্র বা রসায়নিক দ্রব্য যা জীবাণুনাশকের জন্য প্রয়োজন তার অভাব বা অনুপস্থিতি ঘটলে, আগে তা সারিয়ে বা জোগাড় করে তবেই মানুষের সেবা শুরু করা উচিত। নতুবা এই সেবা প্রহসন।

এটা কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না। দেশের নিরীহ মানুষকে এই ফাঁদ থেকে বের করে আনা সরকারসহ সব চিকিৎসকের অবশ্য কর্তব্য।

এইচআইভি সংক্রমণের জন্য দায়ী ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ :
১. ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ
২. যৌন কর্মীদের সঙ্গে সংসর্গ
৩. কনডম ব্যবহার না করা।
৪. সেলুনে জীবানুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা।
৫. একই সিরিঞ্জ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে রুগীদের ইনজেকশন ও অপারেশন করা।
৬. সংক্রমিত মায়ের সন্তান গ্রহণ।

 

যেভাবে ছড়ায় নাÑ
১) একই থালায় খাবার খেলে
২) মশার কামড়ে
৩) একই পায়খানা ব্যবহার করলে
৪) হাঁচি-কাশির মাধ্যমে।
এইচআইভির বিস্তারÑ

১৯৮১ সালে প্রথম এইডস রোগী আমেরিকা ও ফ্রান্সে পাওয়া যায়। ১৯৮৩ সালে এই রোগের জন্য দায়ী এইচআইভি ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়। বিজ্ঞানীরা বিগত ছত্রিশ বছর যাবৎ এ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করার চেষ্টা করে কেবল প্রতিরোধকেই এর একমাত্র প্রতিকার হিসেবে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন। এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। আফ্রিকা মহাদেশে এক বিরাট জনগোষ্ঠী এই ভয়ঙ্কর ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। তাদের জন্য রোগটি এক মূর্তিমান আতঙ্ক। বিশ্বের মোট এইডস আক্রান্তের অর্ধেকের বেশী প্রায় আড়াই কোটিরই বাস এই দরিদ্র ক্ষুধাপীড়িত মহাদেশটিতে। বাংলাদেশে অনেক শিশুও এই রোগে আক্রান্ত। এটি আমাদের জন্য এক মারাত্মক দুঃসংবাদ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ট্রাক-বাস ড্রাইভারদের অনুপ্রবেশ ও দেশের বিভিন্ন বন্দরে বিদেশীদের যাতায়াতের কারণে এসব এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এইচআইভি ভাইরাস কি? : এটি একটি রেট্রোভাইরাস, মানবদেহে প্রবেশের পর তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলে। সাধারণত যৌন মিলনের ফলে এই রোগ হলে রুগী ১০ বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে যেতে পারে। রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে আক্রান্ত হলে ৫ বছর আর আক্রান্ত শিশুরা বাঁচে ৩/৪ বছর। ‘টি’ লিম্ফোসাইট কোষের বিশেষ ধরন হলো সিডি-৪। সিডি-৪ সেলটিকে ধ্বংস করেই এই এইচআইভি ভাইরাস বংশ বিস্তার করে অর্থাৎ এই কোষের ডিএনএ ব্যবহার করে এই ভাইরাসের রিপ্লিকেশন করে। ফলাফল রুগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে খুব সহজেই সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মৃত্যুই হয় এসব রুগীর শেষ পরিণতি।

ভাইরাসটি যেভাবে সংক্রমিত হয়
১. ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশন : আক্রান্ত মা থেকে রোগটি তার সন্তানে সংক্রমিত হতে পারে। এইডস আক্রান্ত মায়েদের শিশুদের জন্ম থেকেই এইডসের ঝুঁকি থেকে যায়। মায়ের দুধ পানÑ এই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তোলে। প্রতি চারটি শিশুর একজন আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত শিশু তিন-চার বছরের বেশি বাঁচে না।

হরাইজেনটাল ট্রান্সমিশন : বডি ফ্লুইড বা শরীরের বিভিন্ন রসের মাধ্যমে হরাইজেন্টাল ট্রান্সমিশন ঘটে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বীর্যরস কোনো সুস্থ দেহে প্রবেশের কারণে অথবা মায়ের দুধ বা ভ্যাজাইনাল সিক্রেশনও এই ধরনের রোগ বিস্তারের জন্য দায়ী। আক্রান্ত ব্যক্তির বর্তমানে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে, আক্রান্ত ব্যক্তিরা থু থু বা স্যালাইভা এমনকি চোখের পানিতেও এই জীবাণু প্রচুর পরিমাণে থাকতে পারে যা ঝুঁকিপূর্ণ।

চিকিৎসকের করণীয় : চিকিৎসা পেশায় জড়িয়ে যে কোনো মানুষই এই রোগটির সরাসরি সংক্রমণের কারণ অথবা তিনি নিজেই সহজে আক্রান্ত হতে পারেন। সুচ-সিরিঞ্জ নিয়ে যাদের কারবার তাদের সামান্য অবহেলা অথবা অসচেতনতা একজন মানুষের জীবনের বিরাট ট্রাজেডি হতে পারে অথবা সেই চিকিৎসকেরই জীবন বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যে কোনো সার্জনের অবশ্য কর্তব্য তার নিজের ও রোগীর স্বার্থে জীবাণুমুক্ত এবং সম্ভব হলে ডিস্পোজেবল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা। আর শুধু আর্থিক দৈন্যতার কারণেই নয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসচেতানতা, পূর্ব অভ্যাস ও উদাসীনতাও এর জন্য দায়ী। আমরা যারা ডেন্টাল সার্জন তারা যদি এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে যথার্থ জনসেবা করতে পারি তবে দেশের মানুষ অনেকখানি ঝুঁকিমুক্ত জীবন যাপন করতে পারে। এতে চিকিৎসা খরচ সামান্য একটু বাড়লেও তার ফল নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।

একজন ডেন্টাল সার্জন হিসেবে আমাদের করণীয় : ‘সম্ভব হলে সবই ডিসপোজেবল ব্যবহার করুন।’ এতে খরচ স্বভাবতই অনেক বেড়ে যায়। রোগীর সচেতনতা তাই জরুরি। রোগী যদি বুঝতে পারে এই ব্যয়টি তার জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা রাখছে তবে অসঙ্কোচেই তিনি তা করবেন আশা করা যায়। আমরা ডাক্তাররাই পারি রোগীদের সচেতন করে তুলতে। বিভিন্ন সেমিনারে আমাদের ক্লিনিক, হাসপাতাল ও প্রাইভেট প্র্যাকটিসের জায়গাগুলোতে পোস্টার লাগিয়ে লিফলেট বিতরণ করে এই কাজটি করা যায়। আর কিছু না হোক নিজস্ব উদ্যোগে আমাদের অবশ্যই উচিত হবে আমাদের যন্ত্রপাতিগুলোর যথাযথ জীবাণুমুক্তকরণ বা স্টোরিলাইজেশন করা। আর নিজেদের জন্য যা অবশ্যই করা উচিত অথচ আমরা করি না তাহলো হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা।

আমাদের স্টেরিলাইজেন (জীবাণুমক্তকরণ) পদ্ধতি :
১) উচ্চ তাপমাত্রায় অনেক জীবাণুই নাশ হয়। সেটা পানিতে ফুটিয়ে অথবা সরাসরি আগুনের সাহায্যে করা যেতে পারে। যেমন : হট এয়ার ওভেন, পাস্তরিত করা ইত্যাদি। অটোক্লেভ মেশিনে করলে এটি সবচেয়ে উপযুক্ত হয়।
২) অল্প তাপে বিভিন্ন পদ্ধতিতেও এ কাজ করা যায়।
৩) রেডিয়েশনের মাধ্যমে যেমনÑ গামা রে, বিটা রে, আলট্রাভায়োলেট রে।
৪) বিভিন্ন ক্যামিকেল বা রাসায়নিক বস্তু
যেমনÑ অ্যালকোহল, ফেনল, হ্যালোজেন ইত্যাদি
এইচআইভি কী কীভাবে দূর হয় : ১০ মিনিট (সাধারণ তাপমাত্রাতেই) পানিতে ফুটিয়ে নিলেই এই মারাত্মক জীবাণুটি দূর হতে পারে। নি¤œলিখিত রাসায়নিক দ্রব্যগুলো বেশ সহজলভ্য। এই সাথে ভাইরাস দূর করতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

১. ১০% গৃহে ব্যবহার্য ব্লিচ
২. ৫০% ইথানল
৩. ৩৫০% আইসোপ্রপানল
৪. ১% ননিডেট পি ৪০
৫. ৫% লাইসল।
৬. ৫% প্যারাফরমালডিহাইড।
৭. ৩% হাইড্রোজেন পার অক্সাইড।

ভাইরাসটি সম্পর্কে সামান্য সচেতনতাই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে পারে এই দেশের নিরীহ সাধাণ মানুষকে। বিশেষত আমরা যারা চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত তারা কখনোই আমাদের উদাসীনতা বা ক্ষতিকর কৃতকর্মের ফল এড়াতে পারব না। এ আমাদের বিবেকের দায়।

 

ডা. তানিয়া নাসরীন
ডেন্টাল সার্জন
ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল
মিরপুর, ঢাকা।

Related posts

অগ্রদূত সমাজকল্যাণ পরিষদের বিনামূল্যে রক্তের নির্নয় কর্মসূচি পালিত

admin

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

admin

ঐতিহ্যবাহী মান্নান হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রথম পুনর্মিলনী র উদ্যোগ

admin